সৈয়দ মুনিরুল হক নোবেল;
জামালপুরের মাদারগঞ্জে এবারও জমজমাট শতবর্ষী ঈদমেলা। বুধবার বিকেলে মানুষের ঢল নেমেছিল মেলায় চারদিকে উৎসবের আমেজ। উপজেলার বালিজুড়ি এফএম উচ্চবিদ্যালয় মাঠে।
জামালপুরের মাদারগঞ্জে এবারও জমজমাট শতবর্ষী ঈদমেলা। বুধবার বিকেলে মানুষের ঢল নেমেছিল মেলায় চারদিকে উৎসবের আমেজ।
বিদায়ী বসন্তের চঞ্চল হাওয়ায় চারদিকে বইছে ঈদ আনন্দের আমেজ। এমন আমেজে শিশু, তরুণ-তরুণীসহ নানা বয়সীরা যাচ্ছেন বালিজুড়ি এফএম উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠের দিকে। নাগরদোলার কড়কড় আওয়াজ, বিচিত্র বাঁশি বা বাদ্যের আওয়াজ ছাপিয়ে কানে আসছে মানুষের হইহুল্লোড়।
বিশাল মাঠের বিভিন্ন জায়গায় চলছে ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁকডাক। ধোঁয়া উঠছে উত্তপ্ত কড়াই থেকে; ভাজা হচ্ছে জিলাপি, চিনির গজা, খুরমা, গুড়ের খইসহ বাহারি মিষ্টান্ন। ঈদ ঘিরে এবারও জমে উঠেছে জামালপুরের মাদারগঞ্জ উপজেলার শতবর্ষী এই মেলা।
সকাল থেকে হরেক রকম দোকান সাজিয়ে বসলেও মেলা জমে ওঠে দুপুরের পরপর। মাঠে জনসমাগম থাকে প্রায় মধ্যরাত পর্যন্ত। স্থানীয় লোকজন জানান, শত বছরে ধরে চলা মেলাটি শুধু ঈদুল ফিতরের দিন থেকে ৭ দিনের জন্য বসে। এ সময় বিভিন্ন এলাকা থেকে দোকানিরা এ মেলায় আসেন। একেবারে শুরুর দিকে মেলায় শুধু ঐতিহ্যবাহী খাবারের কয়েকটি দোকান থাকলেও দিন দিন এর পরিধি ও সংখ্যা বেড়েছে। গ্রামটির বাসিন্দা ও ঈদের ছুটিতে এলাকায় আসা লোকজনই মূলত এসব পণ্যের ক্রেতা। শুধু তা–ই নয়, সারা জেলা থেকে অনেকেই সপরিবার ছুটে আসেন এ মেলায়। মঙ্গলবার বিকেলে মেলায় গিয়ে দেখা যায়, মানুষের ঢল নেমেছে মেলার আশপাশের এলাকায়। শিশুরা অভিভাবকদের হাত ধরে তাড়াহুড়ো করে মেলার ভেতরে যাওয়ার চেষ্টা করছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনার কমতি নেই। আর দোকানিরা তো ক্রেতা সামলাতে মহাব্যস্ত। মেলায় তিলধারণের ঠাঁই নেই।
প্রসাধনী, খাবার, খেলনা, মিঠাই-মিষ্টান্ন, কৃষিপণ্য, মাটির পণ্য, বাঁশ ও বেতের পণ্য, লোহার পণ্য, ফার্নিচারসহ বিভিন্ন ধরনের দুই শতাধিক দোকান আছে মেলায়। আছে চটপটি-ফুচকাসহ মুখরোচক নানা পদের খাবার দোকানও। শিশুদের বিনোদনের জন্য আছে নাগরদোলা, চরকি, দোলনাসহ নানা আয়োজন। সাজিয়ে রাখা হয়েছে বিভিন্ন সাইজের ছোট-বড় মিষ্টি।
মেলায় সন্তানদের নিয়ে খেলনা কিনছিলেন বালিজুড়ি এলাকার আজগর আলী নামের এক ব্যক্তি। তিনি জানান, ঈদের মধ্যে ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যান। এই মেলা ঈদকে আরও আনন্দময় করে তুলে। তিনি নিজেও ছোটবেলা থেকে এ মেলায় আসছেন। এখন বাড়ির ছোট সদস্যদের নিয়ে আসেন। বলা যায়, বংশপরম্পরায় এটি সবার কাছে প্রিয় মেলা।
এই মেলার উৎপত্তি নিয়ে সঠিক তথ্য দিতে পারেননি কেউ। আয়োজক কমিটি সূত্রে জানা যায়, যুগ যুগ ধরে এই মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তবে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের সময় উপজেলার যমুনার চরাঞ্চলে সন্ন্যাসীরা ঘাঁটি করেছিল। সেখানে সন্ন্যাসীরা মন্দির নির্মাণ করে পূজা করতেন। এ উপলক্ষে সেখানে মেলা হতো। ১৯৫২ সালে ঈদ ও পূজার মেলার একই দিনে হওয়ায় হিন্দু-মুসলিমদের দাঙ্গার উপক্রম হয়। তখন মুসলিম নেতারা বালিজুড়ি এফএম উচ্চবিদ্যালয় মাঠে ঈদুল ফিতরের দিন ‘ইসলামি ঈদমেলা’ শুরু করেন। সেই থেকে প্রতিবছর মেলাটি ইসলামি ঈদমেলা নামে পরিচিত।
সেই পুরোনো ধারা বজায় রেখে এখনো প্রতিবছর ঈদুল ফিতরের প্রথম দিন থেকে সাত দিন মেলা বসে। পৌর এলাকার প্রবীণ বাসিন্দা আবদুর রহমান বলেন, ‘মেলায় যমুনার ওই পার থাইক্যা বগুড়ার দই আসত। ওই দইয়ের স্বাদ এখনো মুহে লাইগা আছে। তবে এহন আর ওই দই আহে না।’
গুনারিতলা এলাকার গৃহিণী রাবেয়া বেগম জানান, প্রতি ঈদেই মেলায় আসা হয়। দেখা যায়, আশপাশে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে এখানে দেখা হয়। মেলাটি এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে ঈদের আনন্দ আরও বাড়িয়ে দেয়। মেলায় তিলধারণের ঠাঁই নেই।
মেলায় সবচেয়ে বেশি ভিড় দেখা যায় খেলনার দোকান, যার প্রতিটিতেই ছিল শিশু-কিশোরদের ভিড়। আরেক পাশে দেখা যায় আচারের দোকান। কোনো দোকানে পাঁচমিশালি, চালতা-বরইয়ের মিষ্টি ও ঝাল আচার। আবার কোনোটাতে সাজানো তেঁতুল চাটনি, জলপাই চাটনি, আমড়ার চাটনি, আমফালির মতো ১৪ থেকে ১৫ পদের জিবে জল আসা সুস্বাদু চাটনির পসরা। আচার বিক্রেতা ইসমাইল হোসেন জানান, মেলায় তরুণী ও নারীদের সমাগম সবচেয়ে বেশি। ফলে বেচাবিক্রিও ভালো হচ্ছে। প্রতিবছরই এই মেলায় দোকান নিয়ে বসেন।
মেলা আয়োজক কমিটির সাধারণ সম্পাদক হাফিজুর রহমান বলেন, ব্যাপক উৎসাহ–উদ্দীপনায় মেলা জমে উঠেছে। বিশেষ করে দুপুরের পর নারী-পুরুষ ও শিশুদের ঢল নামে। আশা করছেন মেলাটি সুন্দরভাবেই শেষ হবে।
Leave a Reply