আওরঙ্গজেব কামাল :
দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি মূল্যায়নে গেলে এক কঠিন বৈপরীত্য চোখে পড়ে। সংবিধানে মৌলিক অধিকার, সমতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক অধিকার স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে এসব অধিকার চর্চায় নাগরিকদের নানা বাধা ও ঝুঁকির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। গত ১৫ বছরের একদলীয় শাসনব্যবস্থায় গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, রাজনৈতিক নিপীড়ন এবং মতপ্রকাশের সংক্ষিপ্ত স্বাধীনতা মানবাধিকারকে গভীর সংকটে ঠেলে দিয়েছে। রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার থাকা সত্ত্বেও বাস্তবায়ন অত্যন্ত দুর্বল—এটাই বর্তমান পরিস্থিতির প্রধান সারসংক্ষেপ বললেও মোটে ভুল হবেনা। কিন্তু শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পরে অন্তবর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। সরকারের শত চেষ্টা সত্ত্বেও এখনো পর্যন্ত দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সন্তোষজন জনক নয। বিভিন্ন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী প্রতিদিন দেশে অকারনে ১১ জন লোকের জীবন দিতে হচ্ছে। সাথে সাথে বেবেড়েছে চুরি ও ছিনতাই। এখনো বন্ধ হয়নি প্রশাসনের ঘুষ বাণিজ্য। প্রতিনিয়ত সাধারণ জনগণ বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। গণমাধ্যম কর্মীরাও নিরাপদ নয়। প্রতিনিয়ত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের হাতে বা সন্ত্রাসীদের হাতে সাংবাদিকরা লাঞ্ছিত ও হয়রানি শিকার হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কে সামনে নিয়ে হয়তো এই পরিস্থিতি আরো বাড়তে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে সরকারকে কঠিন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আমাদের সংবিধানের অঙ্গীকারের বাস্তবতা কতটুকু পরিলক্ষিত হচ্ছে সেটা প্রকাশ্য বলার অপেক্ষা রাখে না।সংবিধানের তৃতীয় অংশে জীবন, ব্যক্তি স্বাধীনতা, আইনের চোখে সমতা, ন্যায়বিচার এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে নাগরিকের মৌলিক অধিকার হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ আইসিসিপিআর, সিইডব্লিউএ, সিইডিএডব্লিউ, সিআরসি–সহ মানবাধিকারবিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সনদ অনুমোদন করেছে। জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার পর্যালোচনা (UPR)-তেও দেশটি নিয়মিত অংশ নেয়।কিন্তু আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি ও সংবিধানের অঙ্গীকার বাস্তবে রূপ নিতে পারেনি—এটাই নাগরিক উদ্বেগের মূল কারণ। আমরা জানি ২০০৯–২০২৩: গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার ভয়াবহ অধ্যায় ছিল। দেশের গণতান্ত্রিক পরক্রিয়া মুখ থুবড়ে পড়েছিল। গত এক দশকেরও বেশি সময়ে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং হেফাজতে মৃত্যুর অভিযোগ মানবাধিকার আলোচনার কেন্দ্রে ছিল। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, এসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার না হওয়ায় বিচারহীনতার সংস্কৃতি গভীর হয়েছে। নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবার আজও অপেক্ষমাণ অনিশ্চয়তা ও বেদনার ভেতর দিন কাটাচ্ছে। কিন্তু আমার প্রশ্ন এ থেকে আমরা কতটুকু রক্ষা পেতে পেরেছি। বর্তমানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কিছুটা সংকুচিত এবং সাংবাদিকতা চরম ঝুঁকিতে পড়েছে। যদিও সরকার আপ্রাণ চেষ্টা করছে তবুও কোন ফল পাওয়া যাচ্ছে না। এখনো পুলিশ সাংবাদিকদের অহেতুক মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দিচ্ছে। যার অসংখ্য প্রমাণ আমার কাছে রয়েছে। মিরপুরের এশিয়ান টিভির সাংবাদিক শিাবউদ্দিন, দৈনিক মাতৃ জগৎ পত্রিকার নিজামুদ্দিন কে মিরপুর থানা পুলিশ অহেতুক ভাবে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে কারাগারে প্রেরণ করে। মিরপুরে সাইদুল নামের এক সাংবাদিক কে পিটিয়ে রক্তাক্ত যখন করে এবং মোটরসাইকেল মোবাইল ছিনতাই করে সন্ত্রাসীরা। অভিযোগ করেও এখনো কোন ফল পাইনি। ঢাকা মহানগরীর টেকনিক্যালে অহেতুক মনির বিশ্বাস নামের এক সাংবাদিক কে পিটিয়ে পা ভেঙে দিয়েছে পুলিশ। এ ধরনের অসংখ্য ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। গণতন্ত্রের প্রাণশক্তি হলো মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। কিন্তু বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ওপর হামলা, মামলা, ভয়ভীতি, আইনের অপব্যবহার এবং অনলাইন নজরদারির কারণে সংবাদপত্র ও গণমাধ্যম গভীর সংকটে পড়েছে। শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও ভিন্নমতের প্রকাশ সীমিত করাকে পর্যবেক্ষকরা মানবাধিকার সংকটের বড় কারণ হিসেবে দেখছেন। যদিও সরকার সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কিন্তু এ কাজের অগ্রগতি সীমিত লক্ষণীয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নের কথা বললেও বাস্তবে বড় পরিবর্তন দৃশ্যমান নয়। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে জানিয়েছে—ক্ষমতার শেষদিকে হলেও মানবাধিকার পরিকল্পনার বাস্তবায়নে সরকার ব্যর্থ। তবে সরকার এ প্রতিবেদনকে ‘একপেশে’ দাবি করে সমালোচনা করেছে। প্রতিদিন গড়ে ১১ হত্যাকাণ্ড—নিরাপত্তাহীনতার সর্বোচ্চ মাত্রা এই প্রতিবেদনা মানতে সরকার নারাজ। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ১১ জন মানুষ হত্যার শিকার হচ্ছে। ঘরের ভেতরও মানুষ নিরাপদ নয়—এ চিত্র নাগরিক নিরাপত্তাকে ভয়াবহ প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়েছে। গতকাল শস্যবাড়িয়ায় বাড়িতে ঢুকে এক মহিলাকে হত্যা করে বাড়ির সবকিছু চুরি করে নিয়ে যাই চরচক্র। রাজধানীতে মা মেয়ের হত্যা এই ধরনের ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার দুর্বলতা, বিচার ব্যবস্থার ধীরগতি ও অপরাধ দমনে ব্যর্থতা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করছে। পরিস্থিতি দেখে মনে হয় মানবাধিকার লঙ্ঘনের মূল সমস্যা প্রশাসনিক জবাবদিহির অভাব। আসকসহ মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে—গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, হেফাজতে মৃত্যু, ধর্ষণ, নির্যাতন, জমি দখল, ধর্মীয় সহিংসতা—এসব ঘটনায় তদন্ত ও বিচার না হওয়াই মানবাধিকার বিপর্যয়ের প্রধান কারণ। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত প্রশাসন, স্বচ্ছতা ও যথার্থ জবাবদিহি ছাড়া মানবাধিকার রক্ষা সম্ভব নয়। আমি মনে করি মানবাধিকার উন্নয়নে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে সরকারকে। সেক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানিক জবাবদিহি বাড়াতে হবে। গুম, খুন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের সব অভিযোগ নিরপেক্ষ তদন্তে শত নিষ্ঠাবান প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিয়োগ প্রদান করতে হবে এবং দ্রুত বিচার প্রক্রিয়ায় আনতে হবে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। মানুষকে কথা বলার সুযোগ দিতে হবে। ভিন্নমত গ্রহণযোগ্য এমন গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করা অত্যন্ত জরুরী। দেশে আইনের শাসন শক্তিশালী করতে হবে এবং নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে হবে। বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা ও আইনের প্রয়োগে বৈষম্য রোধ করা অত্যন্ত জরুরি। এছাড়া রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ক্ষমতার অপব্যবহার অচিরেই বন্ধ করতে হবে। দখলবাজি চাঁদাবাজি পেশী শক্তির বিরুদ্ধে জোরালো পদক্ষেপ রাখতে হবে। তাহলে হয়তো এইসব সমস্যা থেকে আমরা মুক্তি পাবো মানবাধিকার শুধুই রাষ্ট্রের দায়িত্ব নয়—এটি একটি সভ্য, ন্যায়ভিত্তিক ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনের ভিত্তি। সেই ভিত্তি দুর্বল হলে রাষ্ট্রের অগ্রগতি, গণতন্ত্র ও মানবিক মূল্যবোধ—সবই বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। তাই আজ সবচেয়ে জরুরি—একটি মানবিক, ন্যায়ভিত্তিক ও নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে মানবাধিকারকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া। আর এইসব বিষয়টি চূড়ান্ত করতে হবে বর্তমান সরকারের। তা নাহলে আবারো গণঅভ্যুত্থান হবে আবারো হাজারো প্রাণ অকালে ঝরে যাবে। তাই এ সরকার ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার আগে আমাদের দেশের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় সশ্রেষ্ঠ হতে হবে।