সৈয়দ মুনিরুল হক নোবেলঃ
জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ উপজেলার সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবু হঠাৎ সব গণমাধ্যমের শিরোনাম। স্থানীয় সাংবাদিক গোলাম রব্বানী নাদিম হত্যার পর তীব্র সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন এ জনপ্রতিনিধি।
কে এই চেয়ারম্যান বাবু? কোন জাদুর ছোঁয়ায় এত সম্পদ, কীভাবে তাঁর রাজনৈতিক উত্থান? খোঁজার চেষ্টা করেছি আমরা। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, এক যুগ আগে তিনি ছিলেন রাজমিস্ত্রি। কিছুদিন নিজ গ্রাম কামালের বার্ত্তি এলাকায় মুদি দোকান নিয়ে বসেন। বাবুর চাচাতো ভাই ছিলেন পুলিশের বড় কর্তা। তাঁর ছায়া পেয়ে ভাগ্য ফেরে বাবুর। খুব অল্প সময়ে হাতে চলে আসে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। বকশীগঞ্জে তাঁর আছে একাধিক বাড়ি, বিঘা বিঘা জমি। গাজীপুরেও বানিয়েছেন বাড়ি। রাজমিস্ত্রি থেকে হয়ে যান সাধুরপাড়া ইউনিয়নের অঘোষিত ‘রাজা’।
সাংবাদিক গোলাম রব্বানী নাদিমের পরিবারের ভাষ্য, চেয়ারম্যান বাবুর অপকর্ম নিয়ে গণমাধ্যমে একের পর এক প্রতিবেদন করায় টার্গেট করে নাদিমকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। পুলিশও বলছে, নাদিম হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী বাবু।
গেল বুধবার রাতে বকশীগঞ্জের পাটহাটি মোড়ে একদল দুর্বৃত্ত বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম এবং একাত্তর টিভির প্রতিনিধি নাদিমকে পিটিয়ে ফেলে রেখে যায়। পরে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার বিকেলে তিনি মারা যান।
এদিকে একসময় সাধুরপাড়া ইউনিয়নের নিজ গ্রামে ছোট্ট মুদির দোকান চালাতেন বাবু। অগ্নিকাণ্ডে দোকান পুড়ে গেলে এর পর পুলিশ কর্তা ওই চাচাতো ভাইয়ের সহযোগিতায় বিভিন্ন মোবাইল কোম্পানির টাওয়ার নির্মাণকাজে রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। ছাত্রজীবনে জাতীয় পার্টির ছাত্রসংগঠন জাতীয় ছাত্রসমাজ করলেও পরে বিএনপিতে ভিড়েছিলেন বাবু। ওয়ান-ইলেভেনের সময় ভোল পাল্টে রাজনীতি ছাড়েন। ২০১১ সালে আওয়ামী লীগে যুক্ত হন বাবু। আওয়ামী লীগে ভিড়েই সাধুরপাড়া ইউপি নির্বাচনে অংশ নেন। ওই নির্বাচনে ফেল করার পর ২০১৪ সালে সাধুরপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ বাগিয়ে নেন। ২০১৬ ও ২০২২ সালে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
এলাকার অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তদবির ও নিয়োগ বাণিজ্য, থানায় দালালি, বিচার সালিশের নামে দুই হাতে টাকা কামাতেন বাবু। তাঁর ছিল ডলারের কারবার। পুলিশ কর্মকর্তার ভাই হওয়ায় থানার অনেকেই বাবুকে সমীহ করতেন। এ সুযোগে অঢেল সম্পদের মালিক হন বাবু। বকশীগঞ্জ পৌর শহরের ব্র্যাক রোডে ১০ শতক জমির ওপর বাড়ি করেন। কামালের বার্ত্তি বাজারে রয়েছে তাঁর চারতলা ভবন ও বেশ কয়েকটি দোকান। গাজীপুরের সাইনবোর্ড এলাকায়ও রয়েছে তাঁর বাড়ি।
এলাকাবাসী জানান, ঢাকায় তাঁর নামে জমি ও ফ্ল্যাট আছে। ২০২১ সালে ফের দলীয় মনোনয়ন পেয়ে চেয়ারম্যান হন বাবু। দ্বিতীয়বার চেয়ারম্যান হওয়ার পর বাবু আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। চলতেন ক্যাডার ও মোটরসাইকেলের বহর নিয়ে।
বাবুর দ্বিতীয় স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, “২০১০ সালে বাবু আমাকে বিয়ে করে ময়মনসিংহে রাখে। ২০১৭ সাল পর্যন্ত সংসার করতে থাকে। তবে কখনও বিয়ের কাবিন আমাকে দেখাত না। সামাজিকভাবে বাড়িতে নেওয়ার দাবি করলে ২০১৮ সালে একটি কাবিননামা দেয়। সেটা দেওয়ার কয়েক মাস পরই জাল তথ্য উপস্থাপন করে তালাকনামা পাঠায়। এর পর ওই তালাকনামা নিয়ে আদালতে দুটি মামলা করেন সাবিনা। তখন আদালতে বাবু জানান, সাবিনাকে নিয়ে সংসার করতে রাজি আছেন তিনি। এর পর আবার তাঁরা সংসার শুরু করেন। ২০২২ সালের নভেম্বরে কন্যাসন্তান আসে তাঁদের সংসারে। এর পর সন্তানের পিতৃত্ব দাবি ও স্ত্রীর সামাজিক মর্যাদা নিয়ে নতুনভাবে সংগ্রাম শুরু করেন সাবিনা। গত মে মাসে সন্তানসহ স্বামীর গ্রামের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলে তাঁকে বেদম মারধর করা হয়। ছোট্ট শিশুর গলাটিপে ধরেন বাবুর স্বজনরা। এর পর ‘৯৯৯’ ফোন করলে পুলিশ গিয়ে সাবিনা ও তাঁর সন্তানকে উদ্ধার করে। পরে সন্তানের পিতৃত্বের দাবিতে বকশীগঞ্জে সংবাদ সম্মেলন করলে সাংবাদিক নাদিম তা নিয়ে একাধিক প্রতিবেদন করেন। এ বিষয়ে প্রতিবেদন লেখার কারণেই টার্গেট করে নাদিমকে হত্যা করা হয়।
সাবিনা আরও জানান, মাঝেমধ্যেই বাসায় ডলার নিয়ে আসত আমার স্বামী। জানতে চাইলে বলত, এসব তুমি বুঝবা না। মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে ডলার ব্যবসা করি।
সাবিনা ইয়াসমিন অভিযোগ করেন, বাবুর নির্যাতনের কথা জানিয়ে বাবুর চাচাতো ভাই ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে ফোন করলেও তিনি কোনো ব্যবস্থা নেননি। উল্টো কেন তাঁকে ফোন করেছি, এটা বলে শাসায়। বাবুর বিরুদ্ধে কথা বলায় আক্কাস নামে আরেক ব্যক্তিকেও মিথ্যা মামলা দিয়ে ফাঁসানো হয়েছে। এমনকি আমার বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ভাইয়ের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। পুলিশ কর্মকর্তার ক্ষমতা অপব্যবহার করেই বাবু এসব অপকর্ম করে আসছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে কেউ মুখ খোলারও সাহস পেত না।
স্থানীয় সাংবাদিক ও নাদিমের পরিবারের সদস্যরা জানান, নাদিম মে মাসে অনলাইন পোর্টালে কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। এর মধ্যে ১০ মে ‘দুইবার বিয়ের পরও সন্তান-স্ত্রী অস্বীকার করছেন ইউপি চেয়ারম্যান!’, ১৪ মে ‘আমি আমার স্বামী চাই, একসঙ্গে সংসার করতে চাই’ এবং ২০ মে ‘আওয়ামী লীগ থেকে স্বামীকে বহিষ্কার চেয়ে স্ত্রীর আবেদন’ শিরোনামের সংবাদ প্রকাশিত হয়। এসব প্রতিবেদন প্রকাশের কারণে নামিদকে শায়েস্তা করার ছক করেন বাবু।
নাদিমকে হত্যার প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় উঠে আসে, দুর্বৃত্তরা চলন্ত মোটরসাইকেল থেকে টেনেহিঁচড়ে নাদিমকে নামায়। তাঁকে উপর্যুপরি কিলঘুসি দিতে দিতে অন্ধকার টিঅ্যান্ডটি সড়কে নিয়ে যায়। সেখানে আগে থেকেই অবস্থান করছিল আরও ১৫-২০ জন। সবাই মিলে তাঁকে পেটাচ্ছিল। আর দূর থেকে নির্দেশনা দিচ্ছিলেন মূল অভিযুক্ত সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা মাহমুদুল আলম বাবু। এক পর্যায়ে কেউ একজন লাথি মেরে পাশে থাকা একটি দেয়ালের ইট ভাঙে। চেয়ারম্যানের ছেলে সেই ইট হাতে নিয়ে রব্বানীকে আঘাত করেন। সাংবাদিক নাদিম বারবার বাঁচার জন্য মিনতি করছিলেন। এক পর্যায়ে মৃত ভেবে তাঁকে ফেলে সবাই সটকে পড়ে।
Design & Developed BY: ServerSold.com
https://writingbachelorthesis.com
Leave a Reply