মো. মহিউদ্দিন আল হেলাল।
একটি দেশের উন্নয়ন, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির জন্য শিক্ষার গূরুত্ব অপরিসীম। যে দেশে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর হার যত বেশি সে দেশের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট তত উন্নত। শিক্ষিত জাতি বিনির্মাণে প্রাথমিক শিক্ষাকে মূল ভিত্তি হিসাবে বিবেবচনা করা হয়ে থাকে। কারন মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চ শিক্ষার পথ সুগোম করে। শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে সকলের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করা আমাদের জন্য অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায় প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে ধনী পরিবারের সন্তানদের তুলনায় দরিদ্র পরিবারের সন্তানগণ শিখন ও পঠনে পিছিয়ে আছে। আবার সুযোগ সুবিধার অসমতার জন্য গ্রামের বিদ্যালয়ের তুলনায় শহরের বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অধিক দক্ষতা নিয়ে মাধ্যমিক স্তরে প্রবেশ করে যার প্রভাব একজন নাগরিকের জীবনব্যাপী বিস্তৃত থাকে। এমনকি মানসম্মত শিক্ষার অভাব পরবর্তীতে কর্মজীবনে সম্মাজনক পেশা ও ভালো মজুরী পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় ধরণের প্রভাব বিস্তার করে। দক্ষ মানব সম্পদ তৈরি করার জন্য মানসম্মত শিক্ষার গূরত্ব উপলব্ধি করে জাতিসংঘ টেকসই উন্নয়ন অভিষ্ঠের ০৪ নম্বর সূচকে দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে সবার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক গুনগত শিক্ষা নিশ্চিত এবং জীবনব্যাপী শিক্ষালাভের সুযোগ সৃষ্টি করার লক্ষ্য নির্ধারিত হয়েছে বিশ্বব্যাপী। ইতোমাধ্যে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করণ এবং শিশুর মনোসামাজিক বিকাশে প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের শিখন দক্ষতা যাচাই করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষার প্রকৃত চিত্র উঠে আসবে। প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যথেষ্ট অগ্রগতি অর্জন করলেও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীগণ পিছিয়ে আছে। ‘লার্নিং টু রিয়েলাইজ এডুকেশন প্রমিজ’ নামক বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায় তৃতীয় শ্রেণির শিশুদের ৬৫% বাংলা সঠিকভাবে পড়তে পাড়েনা। পঞ্চম শ্রেণি পাস শিক্ষার্থীগণ গনিতের মৌলিক সমস্যা সমাধান করতে পারেনা। তাদের মধ্যে মাত্র ২৫ ভাগ নিজ শ্রেণির উপযোগী গানিতিক সমস্যার সমাধান করতে পারে। মূলত নিম্নমানের শিক্ষাদান পদ্ধতি, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতাসহ নানা সমস্যার কারনে শিক্ষার্থীদের সিংহভাগ অংশ প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন ছাড়াই মাধ্যমিক স্তরে প্রবেশ করছে।
যেখানে সারা দেশের প্রাথমিক শিক্ষার চিত্র আশাব্যঞ্জক নয় সেখানে উপকূলীয় এলাকা, চরাঞ্চল, হাওর, পার্বত্য এলাকাসহ দুর্গম এলাকায় প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীগণ পিছিয়ে আছে। চরাঞ্চল ও হাওর এলাকার স্কুল সমূহে পর্যাপ্ত শিক্ষক না থাকা, আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন পর্যাপ্ত বিদ্যালয় ভবন না থাকা, শ্রেণি কক্ষে ইন্টারনেটের সাহায্যে মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার করে পাঠদান কার্যক্রম পুরোদমে চালু না হওয়া, দারিদ্রতার কারনে শিশুদের বড় অংশ অপুষ্টিতে ভোগার কারনে মানসম্মত শিক্ষা অর্জন নিশ্চিত করা আমাদের জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা দিয়েছে। দরিদ্র জনগোষ্ঠী এবং অভিভাবকদের সচেতনতার অভাবে চরাঞ্চল ও হাওর এলাকায় স্কুল গমনেচ্ছু শিশুদের শতভাগ বিদ্যালয়ে ভর্তির লক্ষ্যমাত্রা এখনো অর্জিত হয়নি। আবার এসব অঞ্চলে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের ২৫-৩০% প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন না করেই স্কুল থেকে ঝড়ে পড়ে। প্রাথমিক শিক্ষায় গুনগত মান অর্জন করতে হলে হাওর, চরাঞ্চল, পার্বত্য এলাকাসহ দুর্গম এলাকার জন্য আলাদা পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। চরাঞ্চলের স্কুল সমূহে প্রয়োজনীয় শিক্ষকের ব্যবস্থা করতে হবে। এসব দুর্গম এলাকায় শিক্ষকদের উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্য আলাদা প্রণোদনার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। যেসকল স্কুলে এখনো আধুনিক পাকা ভবন নির্মিত হয়নি সেসকল স্কুলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্কুল ভবন নির্মাণ করতে হবে। শিক্ষার্থীদের শতভাগ স্কুলে উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্য ক্লাস্টার ভিত্তিতে নিয়মিতভাবে অভিভাবক সমাবেশ, মা সমাবেশ, উঠান বৈঠকের আয়োজন করতে হবে। কোন শিক্ষার্থী স্কুলে উপস্থিত না হলে তার কারন সম্পর্কে শিক্ষকগণ অভিভাবকদের সাথে যোগাযোগ করবেন। পাশাপাশি দুর্গম অঞ্চলের রাস্তা ঘাট তথা যোগাযোগ ব্যবস্থার পর্যাপ্ত উন্নয়ন করতে হবে যাতে শিশুদের বিদ্যালয়ে গমন সহজ হয়।সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে দেখা যায় হাওর অঞ্চলে বর্ষাকালে দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য অনেক বিদ্যালয়ে পাঠদান কার্যক্রম কয়েক সপ্তাহ ধরে বন্ধ থাকে। চরাঞ্চলের শিক্ষার্থীরাও ঝড়, জলোচ্ছ্বাসসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারনে বিদ্যালয় বন্ধ থাকার কারনে প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ সকল প্রতিবন্ধকতাকে সঠিকভাবে সমাধান করার মাধ্যমে চরাঞ্চল ও হাওর অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের জন্য ভৌগোলিক চাহিদা অনুযায়ী বিশেষ পাঠ্যক্রম প্রণয়নপূর্বক শিক্ষা লাভের ব্যবস্থা করতে হবে। জনপ্রতিনিধি, ম্যানেজিং কমিটি, শিক্ষা কর্মকতাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এ সকল অঞ্চলে ঝড়ে পড়ার হার কমিয়ে আনতে হবে। দুর্গম ও উপকূলীয় এলাকায় বিদ্যালয়ে গমনেচ্ছু সকল শিশুদের অপুষ্টি দূর করার জন্য সকল বিদ্যালয়ে সরকারি- বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় মিড-ডে মিল চালু করলে শিশুদের মানসিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। জাতিসংঘের ঘোষনানুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে চরাঞ্চল, হাওর, পার্বত্য এলাকাসহ দুর্গম অঞ্চলের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি মানসম্মত শিক্ষা অর্জনের পরিবেশ নিশ্চিত করা যুগের দাবিতে পরিনত হয়েছে।
Design & Developed BY: ServerSold.com
https://writingbachelorthesis.com
Leave a Reply