সেলিম মাহবুব,সিলেটঃ
সিলেটের চৌহাট্টা এলাকায় ১৮৫০ সালে নির্মিত হয়েছিল ঐতিহ্যবাহী আবু সিনা ছাত্রাবাস। এই ভবনটির নকশার নির্মাণশৈলীতে মিশে ছিল ব্রিটিশ,আসাম ও বাংলার অনুপম স্থাপত্য কৌশল। ব্রিটিশ স্থাপত্যরীতির বিশাল ভবনটির উপরিভাগে ছিল আসামের নিজস্ব রীতিতে গড়া পানি নিষ্কাশনের সুবিধার্থে ঢালু টিনের ছাদ। ছাদে আরও ছিল বায়ু চলাচলের জন্য নির্মিত টাওয়ার। ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সাল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় এই ভবনের বর্ধিতাংশে বার্মা-ইংরেজ সৈন্যদের চিকিৎসাদানের জন্য চালু করা হয় মিলিটারি হাসপাতাল। ঐতিহাসিক ভবনটি আর সিলেটে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। কালের আবর্তে এই ভবনের অস্থিত্ব আজ বিলিন। বোল- ডোজার দিয়ে এ ভবনটি গুঁড়িয়ে দিয়ে এখন সেখানে সিলেট জেলা হাসপাতালের নতুন ভবন করা হয়েছে। সে সময় পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী ভবনটি ভাঙার খবরে নগরবাসীর মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল। ভবন রক্ষায় আন্দোলন ও হয়েছে।বিষয়টি নিয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরও ক্ষুব্ধ। কারণ দেড় শতাধিক বছরের পুরনো একটি ভবন ভাঙা হচ্ছে,অথচ তাদের কিছুই জানায় নি গণপূর্ত বিভাগ। সিলেটের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে কাজ করেন এমন কয়েকজন জানিয়েছেন, প্রাচীন জনপদ সিলেটে বর্তমানে পুরনো ভবন নেই বললেই চলে। ১৮৬৯ ও ১৮৯৭ সালে দুটি প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পে সিলেটের প্রায় সব পাকা স্থাপনাই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। শুধু টিকে যায় ‘আবু সিনা ছাত্রাবাস’। তাই ঐতিহাসিক একমাত্র স্থাপনা হিসেবে এটিকে রক্ষার দাবি জানিয়েছিলেন তারা। ভবনটির নির্মাণকাল ও ইতিহাস সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। তবে প্রাবন্ধিক ও গল্পকার সেলিম আউয়াল তার ‘সিলেটের প্রথম সংবাদপত্র ও কবি প্যারীচরণ’ প্রবন্ধে লিখেছেন, সিলেটের প্রথম সংবাদপত্র ‘শ্রীহট্ট প্রকাশ’-এর প্রেস ছিল এই ভবনে। শ্রীহট্ট প্রকাশ প্রকাশিত হয় ১৮৭৬ সালে। সিলেটের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাতা নিরঞ্জন দে জানান, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভবনটি বর্মি ও ব্রিটিশ বাহিনীর ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নথি ঘেঁটে জানা যায়,১৯৩৬ সালে এই বাড়িতে স্থাপিত হয় সিলেট সিভিল হাসপাতাল। ১৯৪৮ সালে হাসপাতাল স্থানান্তরের পর ভবনটিতে সিলেট মেডিকেল স্কুলের যাত্রা শুরু হয়, যা ১৯৬২ সালে মেডিকেল কলেজে উন্নীত হয়। ১৯৭১-৭২ সালে এই মেডিকেল কলেজ, বর্তমান স্থান,নগরীর কাজলশাহতে স্থানান্তরিত হয়। আর ভবনটি মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাস হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে, যার ফলে ‘আবু সিনা ছাত্রাবাস’ নামকরণ করা হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় এই ভবনেও ধ্বংসযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি সেনারা। পাশের হাসপাতালে দায়িত্বরত অবস্থায় পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে শহীদ হন এই মেডিকেলের শল্য বিভাগের প্রধান ডা. শামসুদ্দিন আহমদ। পরে হাসপাতালটি তার নামেই নামকরণ করা হয়। এমন ঐতিহাসিক স্থাপনা ভেঙে ৮৭ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে ২৫০ শয্যার সইলেট জেলা হাসপাতাল। শহীদ ডা. শামসুদ্দিন হাসপাতালকে মা ও শিশু বিশেষায়িত হাসপাতাল করা হবে বলে জানা গেছে।
Leave a Reply